বুধবার, ২৬ জানুয়ারী, ২০১১
২২শে জানুয়ারি পঞ্চগড়ের বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর দিয়ে ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য শুরু
পঞ্চগড় প্রতিনিধি
দীর্ঘ প্রতিক্ষার পর গতকাল শনিবার থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়ি জেলার ফুলবাড়ি ও বাংলাদেশের পঞ্চগড় জেলার বাংলাবান্ধা সীমান্তু দিয়ে ভারত-বাংলাদেশ বাণিজ্য শুরু হয়েছে। বাংলাবান্ধা স্থলবন্দরের বিপরীতে ফুলবাড়িতে ভারতের কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখার্জী এবং বাংলাবান্ধায় কৃষিমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরী এই কার্যক্রমের উদ্বোধন করেন। এসময় দুইদেশের মন্ত্রী সাংসদ, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ও কাস্টমসের উর্ধতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। উদ্বোধন উপলক্ষে দুইদেশের সীমান্তেই ছিল উৎসব মুখর পরিবেশ। রঙিন পতাকা দিয়ে সাজানো হয় বাংলাবান্ধা ফুলবাড়ি সড়ক।
বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সম্পর্ক জোরদার, বাণিজ্য ঘাটতি পুরণ, আমদানি-রপ্তানী বাণিজ্যের সহজীকরণ এবং ব্যবসা-বাণিজ্য সমপ্রসারণের লক্ষ্যে উভয় দেশের মধ্যে এই কার্যক্রম শুরু হয়েছে। তবে প্রথম দিনেই ইমিগ্রেশন চালু হয়নি এ জন্য দুইদেশের নাগরিকরা ইমিগ্রেশন সহ পূর্ণাঙ্গ স্থলবন্দর হিসেবে চালুর দাবি জানিয়েছেন। বেলা একটা ১০ মিনিটে ফুলবাড়িতে বাণিজ্য কার্যক্রম শুরুর ফলক উম্মোচন করেন কৃষিমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরী। এর পর তিনি বাংলাবান্ধা জিরো লাইনে ফিতা কেটে ১২ সদস্য নিয়ে ভারতে প্রবেশ করেন। তাঁর সঙ্গে ছিলেন পঞ্চগড়-১ আসনের সাংসদ মো. মজাহারুল হক প্রধান, সংরক্ষিত আসনের সাংসদ ফরিদা আখতার হীরা, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সদস্য হোসাইন আহমেদ, রংপুর বিভাগীয় কমিশনার জসিমউদ্দিন আহমেদ, জেলা প্রশাসক বনমালী ভৌমিক, পুলিশ সুপার মো. শাহারিয়ার রহমান ও সিএন্ডএফ এসোসিয়েশনের সভাপতি মো. রেজাউল করিম। পঞ্চগড়ের সাংসদ মো, মজাহারুল হক প্রধান ভারতের অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখার্জীর জন্য একটি সোনার নৌকা, একমণ ইলিশ, ১০ কেজি বিশেষ মিষ্টি, ১০ কেজি তুলশী চা, ১০ কেজি গ্রীণ চা উপহার হিসেবে নিয়ে যান। স্থলবন্দরের উদ্বোধনের মূল অনুষ্ঠান ভারতের ফুলবাড়িতে অনুষ্ঠিত হয়। পশ্চিমবঙ্গে নগর উন্নয়ন মন্ত্রী অশোক ভট্টাচার্যের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের অর্থমন্ত্রী প্রণব মুর্খাজী ও বাংলাদেশের কৃষিমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরী বক্তব্য দেন। প্রণব মুর্খাজী তাঁর বক্তব্যে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের বাণিজ্য বৈষম্য রয়েছে বলে স্বীকার করে তিনি বলেন, এটা চলতে পারে না। এই বৈষম্য দূর করতে আমরা দুই দেশ এক সঙ্গে কাজ করছি। বেনাপোল-পেট্রাপোল স্থলবন্দরের চেয়ে ফুলবাড়ি- বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর অনেক সম্ভাবনাময়। কারণ ভারতের উত্তর পূর্বাঞ্চল ও নেপাল ভুটানের গেটওয়ে ফুলবাড়ির কাছেই শিলিগুড়ি। শিগগিরই এই বন্দর দিয়ে ইমিগ্রেশন চালু করা হবে। তিনি আরো বলেন, ভারত- বাংলাদেশের সর্ম্পক ঐতিহাসিক। বন্ধুপ্রতিম দুইদেশের পারস্পরিক আলাপ আলোচনার মাধ্যমে বাণিজ্য বাড়ানোর পাশাপাশি সব সমস্যার সমাধানে আগ্রহী। এই বন্দর চালুর ফলে দু দেশের কলকারখানা গড়ে উঠবে। কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির মাধ্যমে বেকার সমস্যার সমাধান হবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন। কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী বলেন, ভারত-বাংলাদেশের সমঝোতা স্মারকের আলোকে বাংলাবান্ধা-ফুলবাড়ি স্থলবন্দরের বাণিজ্যিক কার্যক্রম শুরু হল। এই বন্দর চালুর ফলে দুই দেশের বাণিজ্য ঘাটতি অনেকাংশে কমে আসবে। ১৯৯৭ সালের ১ সেপ্টেম্বর আওয়ামীলীগ সরকারের আমলে বাংলাবান্ধা ট্রানজিট চালু হয়। আবার মহাজোট সরকারের আমলে বাংলাবান্ধা দিয়ে ভারতের সঙ্গে বাণিজ্যিক কার্যক্রম চালু হল। আশা করছি শিগগিরই এই বন্দর দিয়ে ইমিগ্রেশন চালু করা হবে। পশ্চিম বঙ্গের নগর উন্নয়নমন্ত্রী অশোক ভট্টাচার্য বলেন, ফুলবাড়ি স্থলবন্দরের জন্য ১০ কোটি রুপির প্রকল্প নেয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে আট কোটি রুপি খরচ করে অবকাঠামো নির্মাণ করা হয়েছে। ফুলবাড়ি-বাংলাবান্ধা ভারত-বাংলাদেশ বাণিজ্য পথ উম্মুক্ত করতে পেরে তিনি গর্ববোধ করেন। তিনি বলেন, আগামী ছয় মাসের মধ্যে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণ করে ইমিগ্রেশন চালু করার আশ্বাস দেন। তিনি ঢাকা-বাগডোগরা বিমান চালুর ওপর গুরত্বারোপ করেন। সকল আনুষ্ঠানিকতা শেষে ভারত থেকে পাথরবাহী দুই ট্রাক বাংলাদেশে প্রবেশ করে এবং দুই ট্রাক তুলা ভারতে প্রবেশ করে আমদানী- রপ্তানী কার্যক্রম শুরু হয়।সাপটা চুক্তির আলোকে ১৯৯৭ সালের ১ সেপ্টেম্বর তেঁতুলিয়ার বাংলাবান্ধায় নেপাল- বাংলাদেশ ট্রানজিট রূট চালু হয়। এতদিন এই স্থলবন্ধর দিয়ে নেপাল-বাংলাদেশের মধ্যে সীমিত আকারে পণ্য আমদানি-রপ্তানি হয়ে আসছিল। এই বাণিজ্য কার্যক্রম উদ্বোধনের ফলে সার্কভুক্ত দেশ ভারত, নেপাল ছাড়াও ভুটান এমনকি চীনের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য সমপ্রসারণের সুযোগ সৃষ্টি হবে। আর এটি হলে বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর হবে বাংলাদেশের একমাত্র বহুদেশীয় স্থলবন্দর। এ জন্য সরকার আড়াই কোটি টাকা ব্যয়ে বাংলাবান্ধায় প্রয়োজনীয় অবকাঠামো গড়ে তুলেছে। আমদানিকারক ওয়াকিল আহমেদ বলেন, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর দিয়ে শুধুমাত্র পাথর আমদানি করার কথা উল্লেখ রয়েছে। ফলে ভারত থেকে পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে জটিলতা দেখা দিয়েছে। উদ্বোধনী দিনে বাংলাদেশ থেকে ভারতে আট টন তুলা রপ্তানী করা হবে। ভারত থেকে আসবে ৩৪ টন পাথর। বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর দিয়ে ভারতের বিভিন্ন পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে নতুন করে পণ্য বাছাই করে প্রজ্ঞাপন জারি করতে হবে। তাহলে কেবল এই স্থলবন্দরটি কার্যকর হবে। সিএন্ডএফ এসোসিয়েশনের সভাপতি মো. রেজাউল করিম বলেন, বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ভারত, নেপাল ও ভুটানের সাথে অত্যন্ত সুবিধা ও লাভজনক অবস্থানে বাংলাবান্ধা অবস্থিত। বাংলাবান্ধা সহ এ অঞ্চলটি প্রতি বছর বন্যামুক্ত থাকে। এখান থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরে ভারতের শিলিগুড়ি, ১০ কিলোমিটার দূরে জলপাইগুড়ি শহর, ৫৮ কিলোমিটার দূরে দার্জিলিং, ৬১ কিলোমিটার দূরে নেপালের কারকরভিটা এবং ৬৮ কিলোমিটার দূরে ভুটানের ফুয়েন্টসিলিং শহর। নেপাল ও দার্জিলিং-এ প্রচুর বিদেশী পর্যটক সারা বছরই আসে। বাংলাবান্ধায় ইমিগ্রেশন ব্যবস্থা চালু হলে বাংলাদেশের সমুদ্র সৈকত কক্সবাজার, পতেঙ্গা, কুয়াকাটাসহ পর্যটন কেন্দ্রগুলোতে বিপুলসংখ্যক পর্যটক সমাগম হবে। শিলিগুড়ির রপ্তানিকারক ব্রিজ কিশোর প্রসাদ বলেন, বাংলাদেশের রাজস্ব বোর্ডের প্রজ্ঞাপন সংশোধন করতে হবে। নইলে এই বন্দর কার্যকর হবে না। পাশাপাশি ইমিগ্রেশন চালু করতে হবে। ইমিগ্রেশন সহ বাংলাবান্ধা স্থলবন্দরের পূর্ণাঙ্গ কার্যক্রম চালু হলে পঞ্চগড়সহ আশপাশের জেলাগুলোতে গড়ে উঠবে বিভিন্ন শিল্প কলকারখানা। আর এসব কারখানায় কর্মসংস্থান হবে এ এলাকার হাজার হাজার বেকার মানুষের। আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়ন ঘটবে পঞ্চগড়সহ গোটা উত্তরাঞ্চলের। দেশের অর্থনীতিতে নতুন দিগন্তের সূচনা হবে ।
মোঃ শাহজালাল
এতে সদস্যতা:
মন্তব্যগুলি পোস্ট করুন (Atom)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন